নিউজডেস্কঃ
পটুয়াখালীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সাগরপাড়ের ‘জাহাজমারা’ নামের একটি বালু চরে আগে কখনও ফসল ফলেনি। পতিত পড়ে থাকতো জমি বছরের পর বছর। কৃষকদের চেষ্টায় সেই ধু ধু বালুচরে এখন সবুজে সমারোহ। আগাম তরমুজে ভরে উঠেছে সেই নিস্ফলা জমি। হাসি ফুটছে চাষীদের মুখে। এদিকে গোটা জেলায় বাম্পার ফলন হওয়ায় এবার হাজার কোটি টাকার তরমুজ উৎপাদনের আশা করছেন কৃষি বিভাগ।
সরেজমিনে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দক্ষিনের এই জেলা তরমুজ উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে ভাল অবস্থানে। আবার গোট জেলায় উৎপাদিত তরমুজের অর্ধেকটা পাওয়া যায় রাঙ্গাবালী উপজেলায়। এখানকার অধিকাংশেরও বেশি মানুষ মৌসুমে তরমুজ চাষের সাথে কোননা কোন ভাবে জড়িত।
কৃষকরা জানান, পটুয়াখালীর কৃষি অনেকটাই আমন চাষ নির্ভর। ডিসেম্বরে আমন ফসল ঘরে তোলার পর জানুয়ারী মাস থেকে তরমুজের আবাদ শুরু হয়। এপ্রিল মাসে ক্ষেতের তরমুজ বাজারে বিক্রি শুরু হয়। কিন্তু জাহাজমারা চরের ভূমিহীন চাষীরা অধিক লাভের আশায় গত বছর থেকে ডিসেম্বর মাসেই এই অনাবাদি জমিতে আগাম তরমুজের আবাদ শুরু করেন। জাহাজনামা চরসহ একই উপজেলার কলাগাছিয়া চরেও বালুর মধ্যে আগাম তরমুজ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন এখানকার ভূমিহীন কৃষকরা। এই দুটি চরের প্রায় তিনশত হেক্টর জমিতে এবছর আগাম তরমুজ চাষ হচ্ছে।
তরমুজ চাষী ফারুকের গল্পঃ
ভরদুপুরে তরমুজ ক্ষেতে পরিচর্যায় ব্যস্ত মোঃ ফারুক হোসেন (৪৩)। আলাপচারিতায় নিউজবাংলাকে জানান, “গত হাত-আষ্ট বছর মানষের জমিতে তরমুজের চাষ হরছি। ছিজন শ্যাষে আতে টাহা ত্যামন থাকতোনা। হ্যারপর চিন্তা হরছি মোর নিজের যদি এট্টু জমি থাকতো হ্যারে ভাল অইতো। দুইডা টাহা বেশি পাইতাম। কিন্তু মোর কপালে নাই হেইজন্য জমিও পাইনাই। মুই থাহি আবাসনে। গত বচ্ছর এক বেডায় এইহানে (জাহাজনামা সৈকত) ঘুরতে আইছিল। হেই বেডায় মোরে কইছিল যে, এই বালিতে তরমুজ লাগাইলে ভাল অয়।” এরপরই ফারুকের উদ্যোগে আবাসনে বসবাসকারীদের সাথে আলাপ করে উপজেলা কৃষি বিভাগের পরামর্শে এই বালুচরে আগাম তরমুজের আবাদ শুরু হয়। ফারুক আরো জানায়, ‘গেল বার মোর তিন লাখ টাহা লাভ অইছিল কিন্তু এবার বৃষ্টি না অওয়ায় এবং মিডা পানির অভাবে ফলন নিয়া মুই ট্যানশনে আছি।’ স্ত্রী হাসি বেগম আর সন্তান রুবেলকে নিয়ে এখনও ফারুক দিনভর পরিচর্যা করে যাচ্ছেন। অনাবাদি জমি হওয়ায় তরমুজ আবাদে খরচের পরিমানও অনেক কমে গেছে তাদের। এই চরের সাত একর জমিতে তরমুজ আবাদ করেছেন ফারুক হোসেন। সাড়ে তিন লাখ টাকার মত খরচ হয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি মাত্র ৩৭হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পেরেছেন।
সাগরপাড়ে মিঠা পানির তীব্র সংকটঃ
তরমুজ চাষে প্রচুর পরিমান মিঠা পানির প্রয়োজন। সে জন্য চাষীরা ডিসেম্বর থেকেই বালু চরের মধ্যে বড় বড় কুপ খনন করে সেখানে বৃষ্টির পানি জমা করেন। পরবর্তিতে জানুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রয়ারী মাস পর্যন্ত এই পুরোটা সময়ে তরমুজ গাছের গোড়ায় সেই মিঠা পানি দিতে হয়। এরফলে গাছ দ্রæত বেড়ে উঠে এবং অল্প সময়ে গাছে ফলন ধরে।
কিন্তু এবছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় কাঙ্খিত পরিমান পানি সংগ্রহ না করতে পারায় মিঠা পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে জাহাজমারা আর কলাগাছিয়া চরে। এই দুশ্চিন্তায় এখানকার চাষীরা। আবাসনে বসবাসকারী চাষী মোঃ মোহন গাজী (৫০) জানান, ‘কুয়ায় যেডু পানি আছে হ্যাতে হাত-আট দিন যাইতে পারে। হ্যার মধ্যে সব তরমুজ ওঠবেনা।’ মোহন গাজীর মতে, একদিকে সাগরের লোনা পানি আরেকদিকে ঘের সেখানেও লবন পানি। দুইপাশে লবনাক্ততার কারণে গাছগুলো মরে যাওয়া শুরু করেছে। যে কারণে এবছর লোকসান গোনার আশংকা করছেন তিনি। পাচ একর জমিতে এবার মোহন তরমুজ চাষ করেছেন। যাতে মোট খরচ হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। এখন অবদি মাত্র ৪০হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পেরেছেন।
সোমবার দুপুরে জাহাজমারা চরে চাষীদের সাথে পরামর্শ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন রাঙ্গাবালী উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি অফিসার মোঃ হুমায়ুন কবির। নিউজবাংলাকে তিনি জানান, মিঠা পানির সংকট সরেজমিন পরিদর্শনেও পেয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে উপর মহলের সাথে আলাপ করে যাতে এখানকার চাষীরা পর্যাপ্ত মিঠা পানি পেতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহন করবেন। তিনি জানান, গত বছরের ন্যায় এবছরও জাহাজমারা চরের ত্রিশজন চাষীকে সার, বীজ, কিটনাশক বিনা পয়সায় বিতরণ করা হয়েছে।
কথা হয় কুয়া থেকে কলসিতে করে পানি নেয়া নারী চাষী মোসাম্মদ জুলেখা বেগমের সাথে। তিনি জানান, “এই রৌদ্দের মধ্যে এত কষ্ট হর্ইরা যদি দুডা টাহা না পাই হ্যারে মনডায় ক্যামন লাগে কন? আম্মেরা দোয়া হলেন মোর ফসলডু য্যান ভালো দামে ব্যাচতে পারি।” জুলেখার স্বামী ফেরদৌস প্যাদা জানান, তিন একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। সোয়া লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সমান সমান হয় কিনা সন্দেহ।
তবে অধিকাংশ কৃষকের দাবী, সরকার যদি এই সব এলাকায় সেচের ব্যবস্থার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋৃনের ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে তাদের অভাব অনটন দূর হবে।
রাঙ্গাবালী উপজেলা কৃষি অফিসার মনিরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, একাধিক চর ও নৌপথে যোগাযোগ সহজলভ্য হওয়ায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে রাঙ্গাবালী উপজেলায় তরমুজ চাষ। গত বছরের তুলানায় এবছর একশত হেক্টর বেশি জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। এবছর রাঙ্গাবালী উপজেলায় সাত হাজার ৬০০ ত্রিশ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। যা গোটা জেলায় যে পরিমান উৎপাদন হয়েছে তার অর্ধেক। তিনি জানান, বালুসহ নতুন নতুন জমিতে তরমুজ চাষে আকৃষ্ট করতে চাষীদের সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় মিঠা পানি সরবরাহের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ হৃদয়েশ^র দত্ত নিউজবাংলাকে জানান, গত বছর জেলায় প্রায় সাড়ে ১৪হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছিল। সেখানে প্রায় সাতশত ৫০ কোটি টাকার তরমুজ উৎপাদন হয়েছিল। কিন্তু এবছর জেলায় মোট প্রায় পনের হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে যেখান থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার তরমুজ উৎপাদন হতে পারে বলে তিনি আশা করেন।
