নিউজডেস্কঃ
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে খ ইউনিটে প্রথম হওয়া মোহাম্মদ জাকারিয়া জানান, রাজনীতি আর পড়াশোনা এক সাথে কোনদিন সম্ভবনা। হয় রাজনীতি নাহয় পড়াশোনা এ দুটোর যেকোন একটিকে বেছে নিতে হবে। যেকারণে আমি ছাত্র অবস্থায় রাজনীতিতে জড়াতে চাইনা। আগে পড়াশোনা শেষ করতে চাই। তারপর নিজে স্বয়ং সম্পন্ন হব। চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা। যেটা আমার মা বাবারও ইচ্ছা। আমি চাই তাদের ইচ্ছাকে পূরণ করতে। কারণ মানুষের জন্য কিছু করতে হলে একটি প্লাটফর্ম দরকার। আমি মনে করি সেই প্লাটফর্মটি হলো “রাজনীতি”।
জাকারিয়া জানান, ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার জন্য যদি আমি কারও অবদান মনে করি সেটা হল আমার মা। এর পিছনে তার অবদান শতকরা ৯৯দশমিক ৯৯। তারপর রয়েছে এলাকাবাসী। তাদের উৎসাহ উদ্দিপনার কমতি ছিলনা। আমার পরীক্ষার আগে এলাকাবাসী আমার জন্য মসজিদে মসজিদে দোয়ার আয়োজন করেছিল। তাদের এ ঋন শোধ করার মতন নয়।
ছেলের এই অসাধারণ প্রতিভার জন্য আনন্দে আত্মহারা মা কাজী তাহেরা পারভিন জাকিয়া।
জাকিয়ার সাথে বুধবার সকালে পটুয়াখালী সদর উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের গাবুয়া এলাকার নিজ বাসায় কথা হয় এ প্রতিবেদকের। আবেগআবøুত কন্ঠে শোনান ছেলে জাকারিয়ার এই গৌরব অর্জনের কথা।
জাকারিয়ার বেড়ে ওঠা
২০০১সালের ২জুন তারিখ জাকারিয়ার জন্ম গ্রামের বাড়ীতে। দুই ভাইয়ের মধ্যে জাকারিয়া বড়। ১৪ বছরের ছোট ভাই মোঃ জারিফ বর্তমানে জাকারিয়ার সাবেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডেমরা এলাকার দারুল নাজাত সিদ্দিকিয়া মাদ্রাসায় নবম শ্রেনীতে অধ্যায়নরত। বাবা মোঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম মোল্লা গাজীপুর জেলার শ্রীপুর এলাকায় উইলস মার্কেটিং কোম্পানিতে মার্কেটিং অফিসার হিসাবে ১৯৯৮সাল থেকে কর্মরত আছেন। মা কাজী তাহেরা পারভিন জাকিয়া বরিশালের বাকেগঞ্জের দুধলমৌ ফয়েজ হোসাইন ফাজিল মাদ্রাসায় ২০০৪সাল থেকে সহকারী মৌলভী হিসাবে কর্মরত আছেন। ১৯৯৯সালে বিয়ের পর ২০০১সালে প্রথম সন্তান জাকারিয়া তাদের কোলে আসে। এরপর ২০০২সালে ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ থেকে তিনি অনার্স এবং মাষ্টার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন। তার পরিবারের সবাই শিক্ষিত হওয়ায় ছেলেকে সুশিক্ষিত গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাড়ীর পাশে দক্ষিন বদরপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেনীতে ভর্তি করে দেয়। ওই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেনী থেকে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত ক্লাসে প্রথম হওয়া এবং ২০১১সালে পঞ্চম শ্রেনীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করে জাকারিয়া। যা ছিল পটুয়াখালী জেলায় তৃতীয়। এরআগে ছেলেকে ছোট বেলা থেকেই পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন মা জাকিয়া। যেকারণে বাড়ী সংলগ্ন পাঙ্গাশিয়া নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসায় ২০১২সালে জাকারিয়াকে ভর্তি করানো হয়। পরের বছর তার বাবার কর্মস্থল গাজীপুরের মাওনা শ্রীপুর এলাকার জামিয়া ইসলামিয়া কওমি মাদ্রাসায় কোরানে হাফেজ করানোর জন্য হেফজখানায় ভর্তি করায়। সেখান থেকে ২০১৫সালে জাকারিয়া কোরানে হাফেজ উত্তীর্ন হন। এই ফাকে ৭ম শ্রেনীর লেখাপড়া প্রাইভেট পড়ে সম্পন্ন করে। পরে তাকে আবার পাঙ্গাশিয়া নেছারিয়া মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেনীতে ভর্তি করানো হয় এবং সেখানে সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। যেটি ছিল দুমকী উপজেলার মধ্যে দ্বিতীয়। সেখান থেকে ঢাকার ডেমরার সারুলিয়া এলাকার দারুল নাজাত সিদ্দিকিয়া মাদ্রাসায় ৯ম শ্রেনীতে ভর্তি হয়। ওই ভর্তি পরীক্ষায়ও এক হাজার প্রতিযোগির মধ্যে জাকারিয়া তখন প্রথম হয়েছিল। এরপর ২০১৮সালে দাখিল (এসএসসি) পরীক্ষায় জিপিএ৫ পেয়ে ঢাকা বিভাগে প্রথম হয়েছিল। ২০২০সালে আলিম (এইচএসসি) পরীক্ষায় জিপিএ৫ পেয়ে ঢাকা বিভাগে দ্বিতীয় স্থান হয়েছিল। এরপর ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে করোনা সংক্রমন চলার মধ্যেই ফার্মগেট এলাকায় ‘ফোকাস’ কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন। এরপরের ঘটনা সকলের জানা। গত ২নভেম্বর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে খ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন মোহাম্মদ জাকারিয়া।
জাকিয়া জানান, ছোট বেলা থেকে থেকেই পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ রাখার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহন করেছি। সর্বদা নজরদারীর মধ্যে রাখতে পেরেছি বলেই মহান রব্বুল আলামিন আজ আমার মনের আশা পূর্ন করেছেন। ছেলে হিসাবে কখনও আমার কাছে অতিরিক্ত কোন আব্দার করেনি। যখন যেভাবে পেরেছি ওর মন জয় করার চেষ্টা করিছি। যেহেতু পাচ ওয়াক্ত নামাজি ছিল সেকারণে স্থানীয়রাও ওকে দারুন পছন্দ করতো। আমি চাই বড় হয়ে ও যেন ইহকাল ও পরকালের জন্য ভাল কিছু করতে পারে।
জাকিয়া জানান, যেহেতু জাকারিয়া দ্বিতীয় শ্রেনী থেকে আলিম পর্যন্ত এবং বিভিন্ন মাদ্রাসায় ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আসছে সেই কারণেই আমি সব সময় মনে প্রানে প্রচন্ড রকমের ইচ্ছা পোষন করতাম ও যেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে প্রথম হয়। আল্লাহ তায়ালা আমার মনের সেই আশাটা পুর্ণ করেছে। আমি নামাজ পড়ে সব সময় আল্লার কাছে প্রার্থনা করতাম এজন্য।
তিনি বলেন, আমার ছেলে যেন মানুষের মত মানুষ হয়ে মানুষের সেবা করতে পারে আমি এখন শুধু সেই প্রার্থনা করি। আপনারা সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন।
ইচ্ছা ছিল দীর্ঘদিনের
ঢাবিতে ফাষ্ট হওয়া লাগবে। এখন এক মিনিট লস মানে এক মার্ক পেছনে পড়ে যাওয়া। পরীক্ষার পরে সবকিছুই করা যাবে- এরকম লেখা বেশ কিছু কাগজের টুকরো পড়ার টেবিল থেকে শুরু করে দেয়ালসহ টয়লট এমনকি বেসিংয়ের ওয়ালেও লাগিয়েছিলেন মোহাম্মদ জাকারিয়া। যেগুলো এখনও সেভাবেই পরে আছে। বুধবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায় ঘরের মধ্যে তিন থেকে চারটি পড়ার টেবিল। এরমধ্যে রান্না ঘরেও একটি টেবিল। যেটি দেখিয়ে জাকারিয়ার মা জানান, আমি যখন রান্না করতাম তখন জাকারিয়া এই টেবিলে পড়াশোনা করতো।
জাকারিয়া আরো জানান, সময় বাচানোর জন্য গোসলের পর মা আমাকে লুঙ্গি ধোয়া থেকে বিরত রাখতেন। হাট থেকে বাজার আনতেন তিনি নিজে। কারণ আমাকে বাজারে পাঠালে সময় নষ্ট হবে। খাবার টেবিলে খাবার দিতনা যেখানে যে অবস্থায় পড়াশোনায় ছিলাম সেখানেই খাবার দিয়ে আসতো। তার একটাই কথা ছিল ‘বাবা তোমাকে ঢাকাবিশ^বিদ্যালয়ে প্রথম হতে হবে’ সেই কথাটি এখনও আমার কানে ভাসছে।
স্থানীয় সাবেক মেম্বার আবু জাফর তালুকদার জানান, ছোটবেলা থেকে ওকে দেখে আসছি। অসম্ভব পরিমান ন¤্র ভদ্র শান্ত প্রকৃতির ছেলে ছিল। এলাকায় কারও সাথে কোন দিন কথা কাটাকাটিও হয়নি ওর সাথে। আজকের এই খুশীর সংবাদে আমরা সবাই আনন্দিত। আমরা গর্বিত। গোটা জেলাবাসী আজ আমরা ওর জন্য ধন্য। স্থানীয় বাসিন্ধা বাবুল মৃধা, কবির হোসেনসহ আরো অনেকে জানান, এত ভাল ছেলে এ জমানায় পাওয়া মুশকির। আমরা ওর পরীক্ষার জন্য প্রতিটি মসজিদে দোয়ার আয়োজন করেছি।
জাকারিয়ার প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ নজরুল ইসলাম আবেগ আবøুত হয়ে বলেন, একজন শিক্ষক হিসাবে আজ আমি নিজেকে গর্ব করতে পারি। আমি ধন্য। আমার কষ্ট সার্থক হয়েছে। এত আনন্দ লাগতেছে যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারিনা। আমার সেই ক্লাস টুর ফাষ্ট বয় আজ দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে প্রথম হয়েছে-একজন শিক্ষক হিসাবে এরচেয়ে জীবনে আর কিছু চাওয়া পাওয়ার নাই। আমি জাকারিয়ার সার্বিক মঙ্গল কামনা করি।
