নিউজডেস্কঃ
গত তিন চার বছর ধরে ঢাকা-পটুয়াখালী নৌরুটে আসা যাওয়া করি। করোনার আগে লঞ্চের ডেকে সাধারণ যাত্রীদের ভাড়া ছিল ২০০টাকা। আইলো করোনা। করোনার মধ্যে ভাড়া বাড়লো। হইলো ৩০০ থেকে সাড়ে তিনশো টাকা। তাও একটা পদের মধ্যে ছিল। গার্মেন্টস এ চাকুরি করি। দুই মাস পরপর আসা যাওয়া করতাম। ৩০০টাকা করে আসা যাওয়ায় ৬০০টাকা খরচ একটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। কিন্তু আজকে (মঙ্গলবার) ঢাকা থেকে আসলাম। মনডা খারাপ হয়ে গেল। গতকাল রাতে লঞ্চওয়ালারা ভাড়া নিল ৫০০টাকা। ম্যাজাজটা যে কি পরিমান খারাপ ছিল, কইতে পারিনা। সাথে বউ বাচ্চা ছিল নাহলে ঝগড়া বাধিয়ে দিতাম। প্রত্যেক যাত্রীর কাছ থেকে দেড়শ থেকে দুইশ টাকা বেশি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। বলছে তেলের দাম বাড়ছে সেইজন্য লঞ্চভাড়াও বাড়ছে। কথা হলো-তেলের দাম বাড়াইলো সরকার এরদায়ভার সরকারের। কিন্তু সেই জন্য লঞ্চভাড়া বৃদ্ধি পাবে আর সেই বেশি ভাড়া দিবে আমাদের মত সাধারণ জনগন? এটা কি মগের মুল্লুক? কথায় কথায় জনগনকে মাইনকা চিপায় পড়তে হয় কেন?
এভাবেই রাগ আর ক্রোধ প্রকাশ করলেন ঢাকার কেরানিগঞ্জে একটি পোষাক কারখানায় কর্মরত পটুয়াখালীর জৈনকাঠি এলাকার মোঃ ইলিয়াছ মৃধা নামের একজন যাত্রী।
গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকার সদরঘাট থেকে ‘এআর খান’ নামের যাত্রীবাহি ডাবল ডেকারের লঞ্চে করে তিনি পটুয়াখালী আসছেন। মঙ্গলবার সকাল ৭টার সময় কথা হয় তার সাথে লঞ্চঘাটের পাশে খালার চায়ের দোকানে। তিনি জানান, একদিকে বেশি ভাড়া অন্যদিকে চরম ভোগান্তি। যাত্রীর চাপে রাতে নড়াচড়াও করা যায়নি। মনে হয়েছে যেন ঈদ বা কোরবানীর ছুটি। এই শীতে ছাদেও অনেক যাত্রী ছিল। ইলিয়াছ বলেন, একমাসের কামাইতো লঞ্চমালিকরা আজকের ট্রিপেই আদায় করে নিল। আমার সাথে একটা বাচ্চা ছেলে। তার টিকিকের জন্য আমার সাথে যে ব্যবহার করেছে তাতে উচিত ছিল ওদেরকে মারা। গত এক বছরে কোন লঞ্চে বাচ্চাদের টিকিট কেউ চায়নি। আজকে সকালে ওরা তাও চাইলো।
ক্ষোপ প্রকাশ করেন সুন্দরবন-৯ লঞ্চের প্রথম শ্রেনীর যাত্রী লাবনি আক্তার। বলেন মায়ের সাথে দেখা করতে ভার্সিটি থেকে মাঝে মধ্যে আগে আসতাম লঞ্চে। কিন্তু আজকে দেড়হাজার টাকা ভাড়া নিল সিঙ্গেল কেবিনে। আগে যেখানে ছিল এক হাজার থেকে ১১০০টাকা। এভাবে যদি ভাড়া বৃদ্ধি করা হয় তাহলেতো বছরে একবারের বেশি আসা যাবেনা আপনাদের জেলায়। রাগান্নিত কন্ঠে তিনি বলেন, নাম রাখা হয়েছে প্রথম শ্রেনী অথচ কেবিনের সামনে যাত্রী ঘুমান অবস্থায় ছিল। কেবিনের দরজা খুলতে সমস্যা হয়েছে। তারপর নিরাপত্তার অভাবতো আছেই। তিনি বলেন, মালিকপক্ষ অহেতুক ভাড়া বৃদ্ধি করছে। নিজেদের পকেট ভারী করার জন্য। কারণ, ‘আপনি দেখেন যদি মালিকের লোকসানই হতো তাহলে প্রতি বছর এত বড় বড় হাই ফাই কোম্পানির বিলাস বহুল লঞ্চ কেন নামাচ্ছেন তারা? নিশ্চয়ই এই রুটে ব্যবসা ভাল হয়।’ আসল কথা হলো কি জানেন-জনগনের পকেট মাইর। জনগনের ভোগান্তি।
গতকাল রাতে ঢাকা সদরঘাট থেকে ছেড়ে আসা ‘আসা যাওয়া’ লঞ্চের প্রথম শ্রেনীর আরেক যাত্রী মোঃ হুমায়ুন কবির বলেন, ‘দেখেন একটি ডাবল কেবিনের সামনে সাধারণ যাত্রী কিভাবে বসে আছে। এতদিন আসতাম দুইহাজার টাকা ভাড়া দিতাম আজকে দিতে হয়েছে ২৮০০টাকা। তারপর রাতে খাবারের যে বিল ভাউচার দিছে তাতে মাথায় হাত ওঠার মত। এই দুর্দিনে ৮০০টাকা বেশি দেয়া যে কত কষ্টকর তা আমার মত মধ্যম শ্রেনীর লোকেরাই জানে। তার মতে লঞ্চের এই ভাড়া বৃদ্ধি সম্পূর্ন অহেতুক।
পটুয়াখালী নৌ বন্দর কর্মকর্তা মোঃ মহিউদ্দিন জানান, পটুয়াখালী লঞ্চঘাট থেকে ঢাকার সদরঘাট পর্যন্ত নৌপথের দূরত্ব ২৫২কিলোমিটার। এখানে আগে যাত্রীদের ভাড়া নির্ধারণ ছিল ৩৮৩টাকা। কিন্তু ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির পর আগের সেই ভাড়ার উপর ৩৫ভাগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ঢাকা-পটুয়াখালী নৌরুটে যাত্রীবাহি ডাবল ডেকারের লঞ্চগুলোর সাধারণ যাত্রীদের ভাড়া জনপ্রতি ৫৩৪টাকা পরেছে। অনুরুপ ভাবে ঢাকা-পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর দূরত্ব ২৮২কিলোমিটার। সেই রুটে বর্তমানে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৯৪টাকা যেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রুটের সবচেয়ে বেশি ভাড়া।
কিন্তু লঞ্চ কর্তৃপক্ষ এর চেয়ে কম অর্থাৎ ৩৪টাকা কম নিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে ৫০০টাকা করে আদায় করছেন। যদিও তারা ৩৪টাকা কমের কথা বললেও যাত্রীদের অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে দেড়শ টাকা বেশি। আগে যেখানে সাধারণ যাত্রীদের ভাড়া ছিল ৩০০টাকা এখন তাদেরকে গুনতে হচ্ছে ৫০০টাকা। এ হিসাব শুধু করোনাকালীন সময়ে যাত্রী কম নেয়ার জন্য সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছিল সেটার উপর। কিন্তু করোনার আগে যাত্রীদের যে ভাড়া ছিল সে হিসাবে আজকে যাত্রীদের অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে ২০০ থেকে আড়াইশ টাকা বেশি।
পটুয়াখালী ঘাটে আসা যাওয়া লঞ্চের সুপারভাইজার মোঃ সোলায়মান মিয়া জানান, আমরা সরকারের নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম আদায় করছি। সেটা ডেক যাত্রী বা কেবিন যাত্রীই হউক। যেমন ডেক যাত্রী ভাড়া ৫৩৪টাকা আমরা নিচ্ছি ৫০০টাকা। ডেকযাত্রীর তিনগুন ভাড়া সিঙ্গেল কেবিনে সেই হিসাবে ১৬০২টাকা হয় কিন্তু আমরা সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া নিচ্ছি ১৫০০টাকা। আবার সিঙ্গেল কেবিনের দ্বিগুন ভাড়া ডাবল কেবিনে। সে হিসাবে ডাবল কেবিনের ভাড়া হয় ৩২০৪টাকা অথচ আমরা ডাবল কেবিন ভাড়া নিচ্ছি ২৮০০টাকা।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই রুটে চলাচলরত বিলাস বহুল লঞ্চের একজন সুপারভাইজার অকপটে স্বীকার করলেন ডিজেলের যে মূল্য বৃদ্ধি ধরা হয়েছে তাতে যাত্রী ভাড়া এত না বাড়ালেও পারা যেত। কারণ ঢাকা থেকে পটুয়াখালী আসতে আবার যেতে যে পরিমান তৈল খরচ হয় তাতে এত বেশি ভাড়া না করলেও মালিকপক্ষের লাভ থেকেই যেত। কিন্তু আমরাতো সে কথা বলতে পারিনা।
পটুয়াখালী-ঢাকা রুটে প্রতিদিন তিনটি যাত্রীবাহি ডাবলডেকারের লঞ্চ চলাচল করছে। এছাড়াও রাঙ্গাবালী-ঢাকা, গলাচিপা-ঢাকা এবং কলাপাড়া-ঢাকা রুটে আরো তিনটি করে লঞ্চ চলাচল করছে। এই চারটি রুটে প্রতিদিন অন্তত ১০হাজার মানুষ আসা যাওয়া করছেন।
