নিউজডেস্কঃ
“কল্লা কাইট্যা মোগো জীবন চলে। মাছের কল্লাডা কাইট্টা গিরাস্তোরে (মালিক) দিই আর গুড়াডা মোরা নিই। হেইডা নিয়া বেইচ্চা দুই চাইর টাহা পাইয়া পুতোগো (পুত্র) লইয়া খাই। এইরহম কাজকর্ম হরি। এই কামে কেজিতে দশ টাহা পাই। আর গুড়োডা বেইচ্চা যা পাই হেইয়া লইয়াই জীবন চলে।” পটুয়াখালীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাঙ্গাবালী উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের দাড়ছিড়া নদীর পাড়ে বসে এভাবেই নিউজবাংলাকে জানালেন আসমা তার সংসার চালানোর গল্প। ভরদুপুরে খোলা আকাশের নীচে সকাল থেকে দুপুর আবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা অবদি এভাবেই কাজ করে জীবন চলে আসমাদের। নদীর পাড় থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে তুলাতলী গ্রামের জাফর খলিফার স্ত্রী আসমা বেগম। চার সন্তানের জননী আসমা বেগমের সংসার চালাতে এই কাজ করতে হচ্ছে। সাগরপাড়ের দূর্গম চরাঞ্চল হওয়ায় একদিকে কাজের যেমন অভাব অন্যদিকে সংসার চালাতে হিমশিম তাই বাধ্য হয়েই আসমা বেগম নেমে পরেন প্রতিদিন এই কাজে।
সরেজমিনে দেখা যায় যে, প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ৩০ থেকে অন্তত ৪০টি ট্রলার সাগর থেকে মাছ ধরে সেই নদীর পাড়ে নোঙর করেছে। পাশেই খোলা আকাশের নীচে কয়েকশ নারী শ্রমিক পাতিল নিয়ে বসে আছে। পুরুষ শ্রমিকরা সেই ট্রলার থেকে মাছ উঠিয়ে তীরে ফেলে দিচ্ছে, আর নারীরা তা নিজেদের কাছে নিয়ে বাছাই শুরু করছেন। খালি হাতেই নারীরা চিংড়ি মাছের মাথা ছিড়ে আলাদা করে রাখছেন। পরে চিংড়ির মূল অংশ সেখান থেকে খুলনা এবং ঢাকায় নিয়ে যাবার পর সেখান থেকে বিদেশে রপ্তানি করা হয়।
আসমাদের মত পাচ হাজারেরও বেশি উপকুলের নারী শ্রমিক এ কাজে ব্যস্ত। শুধু এই দাড়ছিড়া নদীই নয়। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন মোহনায় বিশেষ করে রাঙ্গাবালী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এই ধরনের টাইগার চিংড়ির মাথা কাটা কাজে নিয়োজিত আসমাদের মত শ্রমিকরা।
খোলা আকাশের নীচে দিনভর এ কাজে নাই কোন আধুনিক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা। তারউপর কাজের তুলনায় মজুরি কম। তারপরেও সংসার চালাতে বাধ্য অনেক বিধবা নারীও।
কথা হয় বড় বাইশদিয়া ইউনিয়নের তেলীপাড়া গ্রামের পঞ্চান্ন বছর বয়সি সাফিয়া বেগমের সাথে। তিনি জানান, দুই বছর আগে তার স্বামী মারা গেছে। দুই সন্তান নিয়ে সংসার চলে না। তাই এখানে শ্রমিকের কাজ করেন। তার মতে, এখানকার নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি সময় ধরে কাজ করে। কাজের মধ্যে পুরুষেরা বিশ্রামের সুযোগ পেলেও নারীরা তেমন বিশ্রাম নেয় না, কিন্তু পুরুষ শ্রমিকরা যেই টাকা মজুরি পায়, তারা পায় তার অর্ধেক টাকা।
দাড়ছিড়া নদীর পাড়ে ভিড়ানো টাইগার চিংড়ি বোজাই একটি ট্রলারের মালিক সবুজ খা। সবে মাত্র সাগর থেকে এখানে এসে পৌছল। কথা হয় সবুজের সাথে। সবুজ জানান, ’হাত-আট দিনের জন্য বরফ ত্যাল জ¦ালানীসহ ট্রলার লইয়া সাগরে যাই। এরপর জাল দিয়া মাছ ধরি। মাছ ধইরা কিনারে আই। হ্যারপর আড়ৎদারদের ধারে মাছ বিক্রি হরি। হেরাই মহিলাগো দিয়া কল্লা কাইটা খুলনা ঢাহা পাডায়। কারণ মহিলারা এই কাম ভালভাবে করতে পারে। টাহাও কম দেয়া লাগে আবার হেরা কামও দ্রæত করে।’ সবুজ জানায়, সাগরে শত শত ট্রলারে করে এই টাইগার চিংড়ি ধরা হয় প্রতিনিয়ত।
কথা হয় বড় বাইশদিয়া ইউনিয়নের চিংড়ির আড়ৎদার রেজাউল করিমমের সাথে। তিনি জানান, এ অঞ্চল থেকে চিংড়ি ক্রয় করে খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখানকার ফ্যাক্টরীতে সেই চিংড়ি বিক্রি করা হয়। পরবর্তিতে ফ্যাক্টরী কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ধরনের প্রসেসিং করে সেই চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি করে। বিশেষকরে বেলজিয়ামে সবচেয়ে বেশি যায় দক্ষিনাঞ্চলের এই টাইগার চিংড়ি। তিনি জানান, সাইজের উপর এই চিংড়ির দর উঠানামা করে। সাধারণত ভাল সাইজের টাইগার চিংড়ি প্রতি মন সাত থেকে ১০হাজার টাকায় এখান থেকে ক্রয় করে খুলনা যশোর সাতক্ষিরাসহ বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে ২০ থেকে ২৫হাজার টাকা দরে বিক্রি করা হয় বলে তিনি জানান। তারমত আরো অর্ধশত ব্যবসায়ী এই পেশায় জড়িত বলেও তিনি জানান।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পটুয়াখালী জেলা শাখার সভাপতি শোভা রানী রায় বলেন, ‘মজুরিবৈষম্য দূর করতে সামাজিক আন্দোলন দরকার। এছাড়া নারীদের জন্য শ্রমিক বান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলা দরকার। তাহলে নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি আদায় নিয়ে আর কোন সমস্যা থাকবেনা।’
সাস্টেইনেবল কোষ্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের বরিশাল বিভাগের উপ প্রকল্প পরিচালক মোঃ কামরুল ইসলাম জানান, শরীরে বাঘের মত ডোড়াকাটা দাগ থাকায় ‘টাইগার চিংড়ি’ নামে পরিচিত এই মাছের বিদেশে প্রচুর চাহিদা। যেকারণে খুলনা, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই মাছ প্রক্রিয়াজাত করণে খরচ বেশি হওয়ায় এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা কম খরচে উপকুলের নারী শ্রমিকদের ব্যবহার করছে। তিনি জানান, ইউরোপিও ইউনিয়নভূক্ত দেশ ছাড়াও চীন টাইওয়ান ফিলিপিন ও জাপানে রপ্তানি করে প্রচুর পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়ে থাকে। সাগরের ২০ থেকে ৩০ মিটার গভীরতায় এই চিংড়ির আধিক্য বেশি। বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর এই চিংড়ি সংরক্ষনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলেও তিনি জানান।
পটুয়াখালী জেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্লাহ জানান, অপরিকল্পিত ও মানসম্পন্ন উপায়ে মাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ না হলে বিদেশ থেকে ফেরত পাঠানো হয়। সেক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের উপকুলের এই পদ্ধতি ব্যবহার না করার পরামর্শ তার। তিনি জানান, দেশের মৎস্য খাত থেকে বছরে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ৯০ভাগই এই চিংড়ি থেকে। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা ইতিমধ্যে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী এবং কলাপাড়া উপজেলায় দুটি ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মানের পরিকল্পনা করছি। এটি নির্মিত হলে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে এ অঞ্চলের নারী পুরুষ শ্রমিকরা এই চিংড়ির প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজ করতে পারবে। তখন আর বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে কোন ঝুকি থাকবেনা। তিনি জানান, বিষয়টি ইতিমধ্যে আমি মন্ত্রনালয়ে লিখিত ভাবে আবেদনও করেছি। হয়তো আগামী অর্থ বছরে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হতে পারে। তিনি আরো বলেন, ওই আবেদনে উপকূলীয় এলাকার যেসকল স্থানে মাছ বাছাইয়ের কাজ চলছে তা চিহ্নিত করে সেখানে পাকা করে শেল্টার, সেড নির্মান, পৃথক শৌচাগার, পানির ব্যবস্থার পাশাপাশি, নারীদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টিও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে নারীদের জন্য শ্রমিক বান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠবে।
